mangalyan – মঙ্গলযান কি, মঙ্গলযান কবে লঞ্চ হয়েছিল, এর বৈশিষ্ট্য, কি কি সাথে পাঠানো হয়েছিল, কবে পৌঁছিয়েছিল, কি কি খোঁজার জন্য পাঠানো হয়েছিল জানুন বিস্তারিত।
আপনারা তো মঙ্গল গ্রহের নাম অবশ্যই শুনেছেন। যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটতম গ্রহ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন আজ থেকে কয়েকশো কোটি বছর পূর্বে মঙ্গল গ্রহ বসবাসযোগ্য একটি গ্রহ ছিল। সেখানেতেও প্রাণীর বসবাস ছিল। উপযোগী বায়ুমন্ডল সহ জলও ছিল।
কিন্তু কোন কারণবশত মঙ্গল গ্রহের সমস্ত জল শুকিয়ে যায়। এবং গ্রহটি ধীরে ধীরে জলহীন এবং প্রাণীহীন হয়ে ওঠে। কেননা জলের অস্তিত্ব যেখানে থাকে না সেখানে প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা অসম্ভবকর। তাইতো বলা হয়ে থাকে জলের অপর নাম জীবন।
সমস্ত বিশ্বের বৈজ্ঞানিক গণদের মতে আজও মঙ্গল গ্রহের কোনো না কোনো অঞ্চলে জীবের অস্তিত্ব রয়েছে। আর এই কারণেই সারা বিশ্বের স্পেস এজেন্সি অর্থাৎ মহাকাশীও গবেষণা কেন্দ্রগুলি মঙ্গল গ্রহের প্রতি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে, এবং মানবজাতির ভবিষ্যতের বাসস্থান হতে পারে বলেও মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
এই একই বিষয়ে আগ্রহ হয়ে ভারতীয় মহাকাশীও গবেষণা সংস্থা অর্থাৎ ISRO ( Indian space research organisation) ৫ই নভেম্বর ২০১৩ সালে নিজেদের প্রথম ইন্টারপ্লানেটারই মিশন মঙ্গলযানটিকে লঞ্চ করেছিল মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে। এই মার্স ওরবিটারি মিশন ২৪ শে সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে স্থাপিত হয়। এবং আজও সফলতার সাথে কাজ করে চলেছে।
আজ আমরা ইসরোর মঙ্গলযান (mangalyan) সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। বৈজ্ঞানিক গানের মত অনুযায়ী মঙ্গল আমাদের সৌরজগতের এমন একটি গ্রহ, যেখানে আমাদের পৃথিবীর মতোই প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যার প্রধান কারণ হলো মঙ্গল গ্রহে লিকুইড ওয়াটার, মিথেন গ্যাস, অর্গানিক মলিকিউলের উপস্থিতির জন্য।
বৈজ্ঞানিকগণ মঙ্গল গ্রহের দুই মেরু অঞ্চলের বিশাল বরফের আস্তরণের নিচে লিকুইড ওয়াটারের বিশাল ভান্ডারের উপস্থিতির সম্ভাবনার সংকেত পেয়েছেন। একই সাথে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডলে মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব বিশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে। নাসার দ্বারা মঙ্গল গ্রহে পাঠানো রোভারগুলিও মঙ্গল গ্রহের সারফেসে উপস্থিত অর্গানিক মলিকিউলসের খোঁজ করেছে।
একদিকে যেমন বিশুদ্ধ জল ও বিশুদ্ধ মলিকিউল গুলি জীবন পরিস্ফুটনের জন্য অত্যাবশ্যক, অন্যদিকে মিথেন গ্যাসের উৎপত্তির কারণ হিসেবে জীবনের উপস্থিতিকে দায়ী করা হয়।
ভারতীয় বৈজ্ঞানিকগন মঙ্গলযানের ( mangalyan ) পরিকল্পনা ২০১০ সালের আগস্ট মাসেই শুরু করে দিয়েছিলেন। এবং ২০১২ সালের আগস্ট মাসে এটি ভারত সরকার দ্বারা মঞ্জুরপ্রাপ্ত হয়। এবং ভারতীয় বৈজ্ঞানিকগণ মাত্র ১৫ মাস সময়ের মধ্যে এদিকে সম্পূর্ণ রূপদান করেন। এরপর ৫ই নভেম্বর ২০১৩ সালে PSLV C২০ রকেটের সাহায্যে শ্রীহরিকোটা স্পেস সেন্টার থেকে এটিকে উৎক্ষেপণ করা হয়। ও সফলতার সাথে এটিকে পৃথিবীর কক্ষপথে উপস্থাপন করা হয়।
এরপর থেকে এটি সুদীর্ঘ ও ক্লান্তি পূর্ণভাবে মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়ে যায়। সর্বমোট চারটি ঢাকে এর কক্ষপথ কে ভাগ করা হয়, এবং এটিকে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয়। মঙ্গলযানটি মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছানোর পূর্বের কিছুদিন ইসরোর বৈজ্ঞানিক গণের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ সময় ছিল।
কারণ ৩০০ দিনের জন্য বন্ধ থাকা এটির প্রধান ইঞ্জিন ও থ্রাস্টার গুলিকে চালু করা জরুরী ছিল। মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে প্রবেশের দুই দিন আগে অর্থাৎ ২২শে সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে এটির ৮টি থ্রাস্টার ও প্রধান ইঞ্জিনটিকে কেবল ৪ সেকেন্ডের জন্যই চালু করার প্রয়োজন ছিল। এবং যেটিকে ISRO সম্পূর্ণ সফলতার সাথে পরিণতি দিয়েছিল।
অবশেষে প্রায় ১০ মাসের দীর্ঘ অপেক্ষা ও প্রায় ৬৭ কোটি কিলোমিটার বিরামহীন যাত্রার পর মঙ্গল যানটি ২৪ শে সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে সফলতার সাথে স্থাপিত হয়।
মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে প্রথম সংকেত প্রেরণের জন্য যানটির প্রায় ১২ মিনিট ২৮ সেকেন্ড সময় লেগেছিল। এই সংকেতটিকে NASA এর আমেরিকায় কেমবেরা ও গোল্ডস্টোনে অবস্থিত ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক স্টেশন মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়েছিল। এবং রিয়েল টাইমে ভারতে অবস্থিত ISRO এর স্পেস সেন্টারে পাঠানো হয়।
মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে স্থাপন হওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই এটি মঙ্গল গ্রহকে পরিক্রমা করতে শুরু করে দেয়। মঙ্গলযানটির মঙ্গল গ্রহকে একটিবার প্রদক্ষিণ করতে প্রায় ৭২ ঘণ্টা ৫১ মিনিটের মতো সময় লেগেছিল। মঙ্গলযানটি একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে মঙ্গল গ্রহকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। যার মঙ্গল গ্রহ থেকে সবচেয়ে নিকটতম দূরত্ব ৩৬৫ কিলোমিটারের মতো, এবং সর্বাধিক দূরত্ব ৮০ হাজার কিলোমিটার এর মতো।
মঙ্গলযানটির ( mangalyan ) মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে স্থাপনের সাথে সাথে আমাদের দেশ এমন একটি কৃত্রিম মান রচনা করে ফেলেছে, যেটি আজও অবধি অনেক বিকশিত দেশের নাগালের বাইরে। আজ অব্দি অন্য যে কোন গ্রহের তুলনায় মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশ্যে সবথেকে বেশি স্পেস মিশন পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে অধিকতর মিশন গুলি অসফল হয়েছে।
পৃথিবীর অনেক দেশ আজ পর্যন্ত মঙ্গল গ্রহে ৫১ টি যান পাঠিয়েছে, যে গুলির মধ্যে মাত্র ২১ টি মিশনি সফল হয়েছে। কিন্তু ভারতের মঙ্গলযান মিশনটি ৬৭ কোটি কিলোমিটার দীর্ঘ যাত্রা করে প্রথম প্রচেষ্টাতেই মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছে গিয়েছিল।
মঙ্গলজান মিশনের সফলতার সাথে সাথে ভারতবর্ষ প্রথম প্রচেষ্টায় মঙ্গল গ্রহে যেতে পারা প্রথম দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়। এখন পর্যন্ত ইউরোপ স্পেস এজেন্সি, আমেরিকান স্পেস এজেন্সি এবং রাশিয়ান স্পেস এজেন্সি কেবলমাত্র মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে অথবা মঙ্গল গ্রহটির সার্ফেসে যেতে সক্ষম হয়েছে, সেটিও আবার অনেক প্রচেষ্টার পরে।
ISRO এর মার্শ রবিটরটির আকার ছিল একটি ন্যানো গাড়ির সমান, এবং এই মঙ্গল যার মিশনটির জন্য খরচ হয়েছিল ৪৫০ কোটি টাকার মত। যা ছিল আজ থেকে পাঠানো সবচেয়ে সস্তা এন্টারপ্রেনেটারি মিশন, জেটির প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছিল মাত্র চার টাকা করে।
অন্যদিকে একই সময়ে নাসার দ্বারা পাঠানো একটি স্পেস যানের খরচ হয়েছিল প্রায় ৪৭০০ কোটি টাকা। mangalyaan টির মোট ওজন ছিল প্রায় ১৩৫০ কিলোগ্রামের মত। এবং যেটিতে মোট পাঁচটি সাইন্টিফিক ইন্সট্রুমেন্ট যুক্ত ছিল।
যেটির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রথম ইন্সট্রুমেন্ট হল ‘মার্শ কালার ক্যামেরা’, যা একটি অতি সংবেদনশীল ইলেকট্রিক অপটিক্যাল সেন্সর ক্যামেরা, যেই ক্যামেরাটি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন রঙে মঙ্গল গ্রহের ছবি তুলতে সক্ষম ছিল।
দ্বিতীয় ইন্সট্রুমেন্টই হলো ‘থার্মাল ইনফ্রারেড ইমেজিং স্পেকট্রোমিটার’ যেটি মঙ্গল পৃষ্ঠের তাপমাত্রা নিঃসরণসহ হটস্পট গুলিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম।
তৃতীয় ইন্সট্রুমেন্টই হলো ‘মিথেন সেন্সর ফর মার্শ’, যেদিকে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডল সহ ভূপৃষ্ঠে উপস্থিত মিথেন গ্যাসের খোঁজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
চতুর্থ ইন্সট্রুমেন্টটি ছিল ‘লাইমেন আলফা ফটোমিটার’, যা একটি ছোট মাপের ফটো মিটার, মঙ্গল গ্রহের এক্সোস্ফিয়ারে উপস্থিত ডিউটেরিয়াম থেকে হাইড্রোজেন প্রাচর্যের অনুপাত নির্ণয় সক্ষম ছিল।
পঞ্চম ইন্সট্রুমেন্টে হল ‘মার্শ একজোসফেয়ারিক নিউট্রাল কম্পোজিশন এনালাইজার’ যেদিকে মঙ্গল গ্রহের নিউট্রাল একজোসফেয়ারের কম্পোজিশন গুলির অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে ডিজাইন করা হয়েছিল।
মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে প্রবেশের পর, মঙ্গল গ্রহের বায়ুমন্ডল, খনিজ এবং মঙ্গলের সংগঠনের বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে মঙ্গল যানটির ছয় মাসের কার্যকাল নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আজ প্রায় কয়েক বছর হয়ে গেল, তবুও এটি নিপুণতার সঙ্গে এখনো পর্যন্ত সঠিকভাবে কাজ করে চলছে। এবং সময়ের অন্তরালে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৃথিবীতে প্রেরণ করে চলছে।
এই মিশনটি ভারতীয় স্পেস এজেন্সি ISRO এর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এটি ভারতের প্রথম ইন্টারপ্লানেটারি মিশন ছিল। এই মিশনের সফলতার সাথে সাথে ভবিষ্যতের ইন্টারপ্লানেটারি মিশন গুলির সঞ্চালন, ডিজাইনিং, প্ল্যানিং এবং যোগাযোগের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত বিকাশে যথেষ্ট উপকার মিলে ছিল। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল চন্দ্রযান-২, এবং বর্তমানে ২০২৩ সালে পাঠানো চন্দ্রযান-৩। ভারতের মঙ্গলযান-২ (mangalyan 2) এর পরিকল্পনা চলছে, যেদিকে ২০২৪ সালে উৎক্ষেপণ করার সম্ভাবনা রয়েছে।
যাইহোক মঙ্গল গ্রহ এবং চাঁদকে নিয়ে ভারতের স্পেস এজেন্সি ISRO এর অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। যেগুলি আগামী কয়েক বছরে সম্পূর্ণ হতে পারে। যার ফলে ভারত স্পেস টেকনোলজি দিক থেকে অন্যান্য অনেক দেশকে পিছিয়ে ফেলবে।