Wb climate & weather – পশ্চিমবঙ্গের ঋতু অনুযায়ী জলবায়ু ও আবহাওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

Wb climate & weather

এটা আমরাও জানি এবং অনুভবও করি, যে বছরের কোন এক সময় কয়েক মাস ধরে থাকে খুবই গরম। আবার দু থেকে তিন মাস থাকে খুবই ঠান্ডা। এবং কয়েক মাস ধরে চলে বৃষ্টির দমদমা।

কিন্তু এখন আপনাদের মনেতে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুর প্রকৃতি কিরূপ? আমরা হয়তো অনেকেই জানি পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু হলো ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু প্রকৃতির। এখানে তো একটি প্রশ্ন দাঁড়ায়, কেন জলবায়ুটি ক্রান্তীয় মৌসুমি প্রকৃতির?

তো দেখুন আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে একটি রেখা ক্রস করে গিয়েছে। রেখাটি হল কর্কটক্রান্তি রেখা। তো দেখুন পুরো পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বৃত্তাকার কতকগুলি রেখা কল্পনা করা হয়েছে। ওই রেখা গুলোকে বলা হয় অক্ষরেখা। পৃথিবীতে এরকম প্রায় ১৭৯ টি অক্ষরেখা রয়েছে।

এখন কথা হচ্ছে কেন আমাদেরকে এই অক্ষরেখা গুলি সম্পর্কে জানতে হচ্ছে জলবায়ু জানার জন্য। দেখুন পৃথিবী যেহেতু সাড়ে ৬৬ ডিগ্রি কোন হেলে সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। সেই কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে সূর্যের কাছাকাছি এসে থাকে। তো অক্ষরেখার উপর সূর্য রশ্মি পতন কোণের পার্থক্যের জন্যই। অক্ষরেখার উপর ভিত্তি করেই জলবায়ু অঞ্চলকে নির্ধারণ করা হয়ে থেকে।

তো দেখুন নিরক্ষরেখার ঠিক উত্তরে ৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা থেকে সাড়ে ২৩ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা, এবং নিরক্ষরেখা থেকে ঠিক দক্ষিনে 5 ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষরেখা থেকে সাড়ে ২৩ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষরেখা পর্যন্ত অংশটিকে বলা হয় ক্রান্তীয় অঞ্চল। এবং এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত জলবায়ু কে বলা হয় ক্রান্তীয় জলবায়।

ক্রান্তীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য হল, গ্রীষ্মকালে যেমন প্রচন্ড উত্তম থাকে তেমনি শীতকালেও ভালোই ঠান্ডা অনুভূত হয়। আবার বর্ষাকালে যথেষ্ট পরিমাণে বৃষ্টি হয়। আমরা যদি রেখা গুলির মধ্যে ভারতের অবস্থান দেখি, তাহলে ভারত কর্কট ক্রান্তি রেখার উপর, উত্তর গোলার্ধের পূর্ব দিকে অবস্থিত। এবং পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান কর্কটক্রান্তির রেখার উপর। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু ক্রান্তীয় জলবায়ু।

এবারে জেনে নেয়া যাক কেন একে মৌসুমী বায়ু বলা হয়। এই মৌসুমী বায়ুর প্রভাবেই পশ্চিমবঙ্গের বৃষ্টিপাত, গরম, শীত , এইতো পরিবর্তন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয়। তাছাড়া মৌসুমী বায়ুভক্ত অঞ্চলের মানুষজনের আর্থসামাজিক অবস্থা মৌসুমী বায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

সুতরাং অবস্থান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু ক্রান্তীয় হলেও। প্রকৃতি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু হল মৌসুমী প্রকৃতির। তাই দুটোকে একসঙ্গে বলা হয় ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু।

👉 পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু সম্পর্কে সাধারণ ধারণা

  • পশ্চিমবঙ্গের গ্রীষ্মকাল আর্দ্র এবং শীতকাল শুষ্ক। কারণ গ্রীষ্মকালে সমুদ্র থেকে স্থলভাগের দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়, তাই সমুদ্রের জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু যেহেতু প্রভাবিত হচ্ছে তাই গ্রীষ্মকাল আদ্র প্রকৃতির হয়। এবং শীতকালে ঠিক এর বিপরীত অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ স্থলভাগের দিক থেকে জলভাগের দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়, সে ক্ষেত্রে বায়ুতে কোন জলীয় বাষ্প না থাকার কারণে বায়ুটি শুষ্ক প্রকৃতির হয়।
  • এই জলবায়ুর অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান হল পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল, শীতলতম স্থান হল দার্জিলিংয়ের সান্দাকফু, শুষ্কতম জেলা হলো পুরুলিয়া। শুষ্কতম স্থান হল বীরভূমের ময়ূরেশ্বর। এবং সর্বাধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চল হল আলিপুরদুয়ার জেলার বক্সা ডুয়ার্স ।

👉 পশ্চিমবঙ্গের ঋতু বৈচিত্র

দেখুন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সময়ে উষ্ণতা, আদ্রতা, বৃষ্টিপাত ইত্যাদির একটা পার্থক্য কিন্তু লক্ষ্য করা যায়। তো এই আবহাওয়ার উপাদানের তারতম্যের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের ঋতুকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বিশেষত যে সমস্ত ঋতুগুলি আমরা নিজেরাও অনুভব করতে পারি। সেগুলি হল – গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল, শরৎকাল, শীতকাল।

🌡️গ্রীষ্মকাল

পশ্চিমবঙ্গে গ্রীষ্মকাল মূলত মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত ধরা হয়ে থাকে। পৃথিবীর অবস্থানের উপর নির্ভর করে আমরা জানি, একুশে মার্চ তারিখে সূর্য নিরক্ষরেখার উপর লম্বভাবে কিরণ দেয়, ফলে একুশের মার্চ দিন এবং রাত্রি সমান হয়। যেহেতু পৃথিবী সাড়ে ৬৬ ডিগ্রি কোন হেলে অবস্থান করে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান বিভিন্ন সময় সূর্যের কাছাকাছি আসছে, এই কারণেই একুশে মার্চের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, নিরক্ষরেখার উত্তর দিকের অংশ অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধ সূর্যের সামনে আছে যাকে বলা হয় বিশেষত উত্তরায়ন। এবং একুশে জুনে সে উত্তরায়ণের সমাপ্তি ঘটে। যাকে বলা হয় কর্কট সংক্রান্তি কারণ এই দিন কর্কটক্রান্তি রেখার উপর সূর্য লম্বভাবে কিরণ দিয়ে থাকে।

সুতরাং ২১ শে জুনের পর থেকে ধীরে ধীরে উত্তরায়ন শুরু হচ্ছে, সুতরাং উত্তর গোলার্ধে সূর্য রশ্মি ধীরে ধীরে কিরণ দিচ্ছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত কর্কটক্রান্তি রেখার উপর, সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গেও মার্চ মাস থেকে মে মাস পর্যন্ত সূর্যরশীল লম্ব ভাবে পড়বে। হরে গ্রীষ্মকালে উষ্ণতা স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে।

  • দার্জিলিং কে বাদ দিয়ে পুরো পশ্চিমবঙ্গের গড় উষ্ণতা ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট এর কাছাকাছি থেকে থাকে। দার্জিলিঙে গ্রীষ্মকালীন গড় উষ্ণতা থাকে প্রায় ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যেহেতু দার্জিলিং পাহাড়ি বা পার্বত্য অঞ্চল তাই উচ্চতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই গ্রীষ্মকালীন উষ্ণতা এই অঞ্চলে কম।
  • পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুর এবং আসানসোলের গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা কখনো কখনো ৪৪ ডিগ্রির কাছাকাছি ছুঁয়ে যায়।
  • ঝারগ্রাম এর কিছুটা অংশ, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার কিছুটা অংশ, পশ্চিম বর্ধমান এবং বীরভূমের কিছুটা অংশ জুড়ে গ্রীষ্মকালীন দুপুরে তে লু নামে গরম বাতাস প্রবাহিত হয়।
  • এছাড়া এপ্রিল ও মে মাসে বিশেষত বিকেলের দিকে কালবৈশাখী ঝড়ও মাঝে মাঝে দেখা দেয়। এই সময় দক্ষিণবঙ্গে উষ্ণতা খুব বেশি থাকায় স্থানীয়ভাবে এই অঞ্চলে নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়, ফলে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বায়ু এই নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসতে থাকে, আসার পর এই দক্ষিণবঙ্গের মাঝের অংশতে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে থাকে।

🌦️বর্ষাকাল

জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই কয়েকটা মাস হলো বর্ষাকাল। জুন মাসের প্রথম পক্ষের দিকে বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখা পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে। যেহেতু এই বায়ু জলভাগ অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে আসে স্থলভাগের দিকে সেই কারণে এই বায়ু আদ্রতা পূর্ণ হয়ে থাকে।

  • পশ্চিমবঙ্গের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৭৬ সেন্টিমিটার হলেও পশ্চিমবঙ্গের সব জায়গায় কিন্তু সমানভাবে বৃষ্টিপাত হয় না, কোন অঞ্চলে বেশি বা কোন অঞ্চলে কমও হয়ে থাকে।
  • পার্বত্য অঞ্চল ও ডুয়ার্স অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে এই বায়ুর প্রভাবে।
  • দক্ষিণভঙ্গের মালভূমি অঞ্চল গুলিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম হয়ে থাকে।

🏄 শরৎকাল

সাধারণত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে নভেম্বরের মাঝে মাঝে সময় পর্যন্ত এই সময়কালকে বলা হয় শরৎকাল। ধীরে ধীরে পৃথিবীর অবস্থানের পরিবর্তনের কারণে নিরক্ষরেখা সূর্যের কাছাকাছি আসতে থাকে, এবং ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখে নিরক্ষরেখার উপর সূর্য রশ্মি লম্বভাবে পড়ে। ফলে এই সময় কর্কটক্রান্তি রেখার উপর সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়ে ফলে পশ্চিমবঙ্গের তাপমাত্রা এই সময় থেকে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। এবং মৌসুমী বায়ুও ধীরে ধীরে এই সময় দুর্বল হয়ে যায়। এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে মৌসি বায়ু ধীরে ধীরে ফিরে যেতে শুরু করে।

  • মৌসুমী বায়ু প্রত্যাগমন শুরু করে ফলে স্থলভাগের উপর উচ্চ চাপের সৃষ্টি হয়। এবং এই সময় স্থলভাগের তাপমাত্রা ২১°c থেকে ২৫°c এর মধ্যে থাকে।

এছাড়া এ সময় বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর এই সমস্ত অঞ্চল গুলি নিরক্ষরেখার কাছাকাছি অবস্থান করে, তাই লম্ব সূর্য রশ্মির কিরণের ফলে ওই সমস্ত অঞ্চলের উপকূলবর্তী জল গরম হয়ে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। আমরা জানি যে সাধারণভাবে বায়ু উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিম্নচাপ অঞ্চলের দিকে ধাবিত হয়।

অর্থাৎ স্থলভাগে উচ্চচাপ সৃষ্টির কারণে স্থলভাগ থেকে বায়ু নিম্নচাপের দিকে বয়ে আসে। কিন্তু জলবায়ুর বায়ু যেহেতু উষ্ণ ও আদ্রতা যুক্ত থাকে , সেই বায়ুর সঙ্গে স্থলভাগের শীতল বায়ুর সংঘর্ষের ফলে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। প্রধানত আশ্বিন মাসের দিকে এই ধরনের দুর্যোগ পরিলক্ষিত হয় বলে সৃষ্টি হওয়া ঝড়টিকে আশিনের ঝড় বলা হয়ে থাকে। এই ঘূর্ণিঝড় এর প্রভাবে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও অন্ধ্রপ্রদেশ বিশেষভাবে ক্ষতিপ্রাপ্ত হয়।

⛄শীতকাল

মূলত শীতকাল পরিলক্ষিত হয় ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। ডিসেম্বর মাসে সূর্যের দক্ষিণায়ন ঘটে থাকে, অর্থাৎ সূর্য এই সময় থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে মকরক্রান্তি রেখার উপর লম্বভাবে কিরণ দিতে শুরু করে। সেই কারণে উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তি রেখার উপর সূর্যরশ্মি খুবই কম পৌঁছায়, ফলে উষ্ণতা স্বাভাবিকভাবেই কম থাকে। সেই কারণে শীতকালে পশ্চিমবঙ্গের তাপমাত্রা অনেকটাই কম থাকে।

  • শীতকালে পশ্চিমবঙ্গের গড় তাপমাত্রা থাকে ১৬°C এর মত।
  • পার্বত্য অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। তবে মাঝে মাঝে হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায় এবং তুষারপাত ঘটে থাকে ।
  • শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ খুবই কম থাকে কারণ স্থলভাগের দিক থেকে এই বায়ু বয়ে আসে যার কারণে আদ্রতা কম থাকার ফলে বায়ু শুষ্ক প্রকৃতির হয়ে থাকে।

তো এইগুলো পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু সম্পর্কে একটি বিস্তারিত ধারণা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *